আদব হল মানুষের জীবনের সৌন্দর্য। ইবাদত-বন্দেগীর আদবসমূহ ইবাদতকে উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ করে দেয়। তাই প্রত্যেকটি ইবাদতের রয়েছে কিছু আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার। কিছু আদব হল অবশ্য পালনীয় যা বাস্তবায়ন না করলে ইবাদতটি গ্রহণযোগ্য হবে না, আর কিছু হল মুস্তাহাব অর্থাৎ যা পালন করলে ইবাদতটি পরিপূর্ণতার সহায়ক হয় এবং ইবাদতের মাঝে কোন ত্রুটি হয়ে গেলে তা কাটিয়ে উঠা যায় ও পরিপূর্ণ সওয়াব পাওয়া যায়। তাই আমরা এখানে সিয়াম পালনের কতিপয় আদব নিয়ে আলোচনা করব। আমরা যদি এ আদবসমূহ মান্য করে সিয়াম আদায় করতে পারি, তাহলে আল্লাহর ফজলে আমরা সিয়ামের পূর্ণ সওয়াব লাভ করতে সক্ষম হব।


(১)
সিয়াম পালন এবং ইসলামকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ করা :

সিয়াম পালনকারী তো বটেই প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য হল আল্লাহ যা কিছু আদেশ করেছেন তা পালন করা। আর যা কিছু নিষেধ করেছেন তার প্রত্যেকটি বর্জন করা। এর নামই হল ইসলাম বা স্রষ্টার কাছে মানুষের পূর্ণ আত্মসমর্পণ। একজন মুসলিম যেমন কখনো নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে পারে না, তেমনি অন্য মানুষের খেয়াল-খুশি বা তাদের রচিত বিধানের অনুগত হতে পারে না। যদি হয়, তবে তা স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করা হল না। যদি এভাবে আল্লাহর বিধান অনুসারে জীবনকে পরিচালিত করা যায়, তাকেই বলা হবে পরিপূর্ণ ইসলাম, পরিপূর্ণ সিয়াম পালন। আর পরিপূর্ণ ইসলামে প্রবেশ করতে আল্লাহর রাব্বুল আলামীন আদেশ করেছেন মানুষকে। সুতরাং সিয়াম পালনের সাথে সাথে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে ইসলাম পরিপূর্ণ ভাবে অনুসরন করতে হবে। 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

‘হে মুমিনগণ! তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।'[১]

সিয়াম পালন তাক্ওয়ার অংশ আর ইলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণ করার নামই হল তাকওয়া। যে তাকওয়া অবলম্বন করতে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বার বার নির্দেশ দিয়েছেন। এ তাকওয়ার দাবি হল, আল্লাহর আনুগত্য করতে হবে, অবাধ্য হওয়া যাবে না। তাকে স্মরণ করতে হবে ভুলে যাওয়া চলবে না। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে অকৃতজ্ঞ (কাফির) হওয়া যাবে না। ঈমানদারের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হল, শিরক ও রিয়া মুক্ত থেকে খালেস আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদতসমূহ সম্পাদন করা যার অন্তর্ভূক্ত সিয়াম। এর মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হল পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। সালাত বাদ দিয়ে সিয়াম পালনের কি মূল্য আছে? দৈনিক পাঁচবার সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে। জামাতের সাথে সালাত আদায়ের মাধ্যমে মুনাফেকি থেকে মুক্তির সনদ নিতে হবে। এরপর যথা সময় যাকাত আদায় করতে হবে। সত্যিকার হকদারকে যাকাত প্রদান করতে হবে। এমনিভাবে যে সামর্থ্য রাখে তাকে হজ ও ওমরাহ আদায় করতে হবে। সাথে সাথে উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে সকলের সাথে আচরণ করতে হবে। মাতা-পিতার সাথে ভাল আচরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক সু-দৃঢ় রাখা, প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ, সাধ্য-মত সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এমনিভাবে জাদু-টোনা, সুদি কারবার, মিথ্যা কথা, ধোঁকাবাজি, ঘুসসহ সকল প্রকার দুর্নীতি, মাদক সেবন, ব্যভিচার, সৃষ্টি জীবকে কষ্ট দেয়া ও গান-বাদ্য পরিহার করতে হবে। মানুষের অধিকারগুলো যথাযথভাবে আদায় করতে হবে, তাহলেই না সিয়াম পালনের যথার্ততা আসবে। 


(২)
সিয়াম পালন এবং সকল প্রকার অন্যায় থেকে বিরত থাকা :

সিয়াম পালন অবস্থায় সকল প্রকার অন্যায় থেকে বিরত না থাকলে সিয়াম কবুলের বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। অনেককে দেখা যায় সিয়াম পালন করে অযথা কথা-বার্তা, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সে খবর রাখে না যে, এ সকল অন্যায় কাজ-কর্ম সিয়াম পালনের প্রতিদান লাভে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের ব্যাপারেই হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

كم من صائم ليس له من صيامه إلا الظمأ، وكم من قائم ليس له من قيامه إلا السهر. الدارمي: ২৭২০

‘অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যারা উপোস থাকা ছাড়া আর কিছু পায় না। আর অনেক রাতজাগা সালাত আদায়কারী আছে যারা রাত্রি-জাগরণ ব্যতীত আর কিছু লাভ করে না।'[২]

অতএব যার উদর সিয়াম পালন করছে তার উচিত তার মুখ, কর্ণ, চক্ষু, হাত ও পা সবকিছুই সিয়াম পালন করবে। সকল অন্যায়-অবৈধ কাজ হতে এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পবিত্র থাকবে। যেমন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

. والصيام جنة، فإذا كان يوم صوم أحدكم فلا يرفث يومئذ ولا يصخب، فإن سابه أحد أو قاتله فليقل إني امرأ صائم . مسلم: ১১৫১

‘সিয়াম হল ঢাল। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করবে সে যেন অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। যদি তার সাথে কেউ ঝগড়া বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায়, তবে তাকে বলে দেবে আমি সিয়াম পালনকারী।'[৩]

রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন :

ليس الصيام من الأكل والشرب، إنما الصيام من اللغو والرفث، فإن سابك أحد أو جهل عليك، فليقل: إني صائم. الحاكم:১৫২০

‘শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়। মূলত সিয়াম হল : অনর্থক-অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। যদি তোমার সাথে কেউ ঝগড়া-বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায়, অথবা মূর্খতা সুলভ আচরণ করে তবে তাকে বলে দেবে আমি সিয়াম পালনকারী।'[৪]

যদি সিয়াম পালনকারী নিষিদ্ধ কথা ও কাজ-কর্ম পরিত্যাগ না করেন, তবে তার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে দুঃসংবাদ :

من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل، فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه. البخاري:৬০৫৭

‘যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে [সিয়াম পালনে] আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।'[৫]


(৩) সিয়াম পালন এবং
 ইখলাস অবলম্বন করা:

কোন কাজে ইখলাস অবলম্বন করার অর্থ হল কাজটা করার উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। শুধু সিয়াম নয়, এ ইখলাস ব্যতীত কোন আমল কবুল হবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও যাকাত দিতে, এটাই সঠিক দ্বীন।”[৬]

আর সিয়াম পালনে ইখলাসের বিষয়টাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

‘যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।'[৭]

এ হাদীসে ‘ইহতিসাবশব্দ এসেছে। এর অর্থ ইখলাসের সাথে সিয়াম পালন করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার কাছ থেকে প্রতিদানের আশা করার নাম হল ইহতিসাব।


(৪)
সিয়াম পালন এবং সুন্নতে নববীর অনুসরণ :

কোন আমল্ তা যতই ইখলাসের সাথে সম্পাদন করা হোক না কেন, যদি আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করা না হয়, তবে তা কবুল করা হবে না। বরং তা আল্লাহর দরবার থেকে প্রত্যাখ্যাত হবে এবং সিয়াম পালনের বেলায় ও একই কথা প্রযোজ্য। 

যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد . مسلم:৪৫৯০

‘যে এমন আমল করবে যার প্রতি আমাদের দ্বীনের নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।'[৮]

যার প্রতি আমাদের দ্বীনের নির্দেশ নেই‘ কথাটির অর্থ হল, যা আমাদের সুন্নত দ্বারা প্রমাণিত নয়। অতএব এমন ধরনের আমল যতই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে করা হোক, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর পক্ষ থেকে অনুমোদিত না হওয়ার কারণে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব কোন ধর্মীয় আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য দুটো শর্ত। তা হল : এক. কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করতে হবে। দুই. কাজটি আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে সম্পাদন করতে হবে। কাজটি যদি আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে সম্পাদন করা না হয় বা এ কাজে তার অনুমোদনের প্রমাণ না থাকে, তাহলে কাজটি করে কোন সওয়াব অর্জিত হবে না। বরং গুনাহ হবে। সুতরাং সিয়াম পালনের ক্ষেত্রেও সর্ব ক্ষেত্রে নবীজির দেখানো পথ অনুসরণ করতে হবে। 

 

(৫) সিয়াম ভঙ্গের সহায়ক বিষয়গুলো পরিহার করে চলা :

সিয়াম পালনকারীকে এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যে, যে সকল আচার-আচরণ সিয়াম ভঙ্গ করার কারণ হয় অথবা সিয়াম নষ্ট করার সহায়ক হয় এমন সকল বিষয় থেকে দুরত্ব বজায় রাখা। বিশেষত: স্বামী স্ত্রীর আলিঙ্গন, চুম্বন বা এক কাঁথা-কম্বলের নীচে শয়ন ইত্যাদি পরিহার করা উচিত। এ সকল কাজ যদিও সিয়াম অবস্থায় করার অনুমতি আছে কিন্তু দেখা গেছে এ সকল কাজ করতে যেয়ে অনেকে সমস্যায় পড়ে গেছে, ফলে সিয়াম ভঙ্গ হয়ে গেছে। প্রত্যেক বিষয়ের একটি সীমানা আছে, এ সীমা যাতে অতিক্রম না হয়ে যায় এ লক্ষ্যে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য হাদীসে নির্দেশ এসেছে। যদিও সীমানা পর্যন্ত যাওয়া বৈধ কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন বিধেয়। মনে রাখতে হবে রমজানের দিনের বেলা সিয়াম ভেঙে ফেলা একটি কবিরা গুনাহ। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনিবা এমনটি হবে বুঝতে পারিনিবলে কবিরা গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। এ ধরনের কথা কখনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না।


(৬)
সিয়াম পালনের সাথে সাথে ভয় ও আশা পোষণ করা :

প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য হল, সিয়াম সালাতসহ সকল ইবাদত সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করা। কিন্তু তার জানা থাকে না যে, তার এ সালাত ও সিয়াম আল্লাহ কবুল করেছেন না প্রত্যাখ্যান করেছেন। অতএব তার সর্বদা এ ভয় থাকা উচিত যে, হয়তো আমি আমার ইবাদত-বন্দেগী এমনভাবে আদায় করতে পারিনি যেভাবে আদায় করলে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। ফলে আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান হয়তো পাব না। আবার এ আশাও পোষণ করা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে আমার ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে আমার ইবাদত-বন্দেগী সিয়াম কবুল করে আমাকে প্রতিদান দেবেন। এ অবস্থার নাম হল আল-খাওফ ওয়ার রজাঅর্থাৎ ভয় ও আশা।এটা ইসলামের একটা গুরুত্বপূর্ণ আকীদা বিষয়ক পরিভাষা।

মনে রাখতে হবে আল্লাহ তাআলা সকলের নেক আমল কবুল করেন না। যেমন তিনি বলেন :

‘অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কাজ কবুল করেন।'[৯]

হাদীসে এসেছে আয়েশা রা. নিম্নোক্ত আয়াতের অর্থ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে জিজ্ঞেস করলেন :

(والذين يؤتون ما آتوا وقلوبهم وجلة) أي خائفة. أهم الذين يشربون الخمر ويسرقون ؟ قال : لا يا بنت الصديق، ولكنهم الذين يصومون ويصلون ويتصدقون وهم يخافون أن لا تقبل منهم. أولئك يسارعون في الخيرات وهم لها سابقون. الترمذي: ৩৪৭৫

‘যারা তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে” আল্লাহ এ কথা কাদের জন্য বলেছেন, যারা মদ্য পান করে, চুরি করে তাদের জন্য? তিনি উত্তরে বললেন : না, হে সত্যবাদীর কন্যা ! তারা হল, যারা সিয়াম পালন করে, সালাত আদায় করে, দান-সদকা করে সাথে সাথে এ ভয় রাখে যে হয়তো আমার এ আমলগুলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী।’ বর্ণনায় : তিরমিযী

বর্ণিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা স্পষ্ট হল যে, আল্লাহ ঐ সকল মুমিনদের প্রশংসা করেছেন যারা নেক আমল করে কবুল হবে কি হবে নাএরকম একটা ভয় পোষণ করে। এবং আমল আরো সুন্দর করার চেষ্টা করে। কিন্তু এ ভয় যেন আবার মানুষকে নৈরাশ্যবাদী না করে। কোন অবস্থাতেই কোন মুসলিম আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত থেকে নিরাশ হতে পারে না। আল্লাহর সম্পর্কে নৈরাশ্যবাদী হওয়া একটা কুফরী। নেক আমল কবুল হওয়ার ব্যাপারে প্রবল আশাবাদী হতে হবে কিন্তু এ আশাবাদী মনোভাব যেন অহংকার ও আত্ম-তৃপ্তিতে ফেলে না দেয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অহংকার ও আত্ম-তৃপ্তি নেক আমলকে বাতিল করে দেয়। অনেক সময় অলসতা নিয়ে আসে। অপরদিকে ভয় মানুষকে তৎপর ও কর্মঠ হতে সাহায্য করে। তাই সকলের উচিত সিয়াম সহ সকল প্রকার নেক আমল করতে হবে ভয় ও আশা নিয়ে। শুধুই ভয় অথবা শুধুই পাওয়ার আশায় নয়।


(৭)
সিয়াম পালনের উদ্দেশে সেহরি খাওয়া:

সিয়াম পালনের জন্য সাহরী খাওয়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

‘তোমরা সাহরী খাও, কারণ সাহরীতে বরকত রয়েছে।'[১০]

সাহরী না খেয়ে সিয়াম পালন করলে যখন সিয়াম আদায় হবে। তবে সাহরী খাবেন কেন ?

(ক) সাহরী খাওয়া সুন্নত। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহরী খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন।

(খ) ক্ষুধা-পিপাসা মোকাবিলা করার জন্য।

(গ) সাহরী খেলে সিয়াম পালনে কষ্ট কম হয় ও সিয়াম পালন সহজ হয়।

(ঘ) ইহুদী ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধাচরণ করা। কারণ তারা সিয়াম পালন করতে সাহরী খায় না। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

فصل ما بين صيامنا وصيام أهل الكتاب أكلة السحور. مسلم:২৬০৪

‘আমাদের ও ইহুদী-খ্রিস্টানদের সিয়ামের মাঝে পার্থক্য হল সাহরী খাওয়া।'[১১]

(ঙ) সাহরীর মাধ্যমে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল লাইল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

(চ) ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায় করা নিশ্চিত হয়।

তাই সাহরী খাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। তবে সাহরীর খাবার হালকা হওয়া ভাল। এমন বেশি খাওয়া উচিত নয়, যাতে দিনের বেলা কাজ-কর্মে অলসতা দেখা দেয়। যে কোন হালাল খাবার সাহরীতে গ্রহণ করা যায়। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

نعم سحور المؤمن التمر. أبو داود:২৩৪৭

‘মুমিনের উত্তম সাহরী হল খেজুর।'[১২] 

তিনি আরো বলেন :

السحور أكلة بركة فلا تدعوه، ولو أن يـجرع أحدكم جرعة من ماء، فإن الله وملائكته يصلون على المتسحرين. أحمد:১১৩৮৪

‘সাহরী হল একটি বরকতময় খাদ্য, তাই তা তোমরা ছেড়ে দিয়ো না। এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও সাহরী করে নাও। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও ফেরেশ্‌তাগণ সাহরীতে অংশ গ্রহণকারীদের জন্য দোয়া করে থাকেন।'[১৩]

 

(৮) সিয়াম পালনে দেরি করে সাহরী খাওয়া :

সাহরীর অর্থ হল যা কিছু রাতের শেষ ভাগে খাওয়া হয়। সুন্নত হল দেরি করে সাহরী খাওয়া। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা শেষ সময়ে সাহরী খেতেন। ফজরের ওয়াক্ত আসার পূর্ব-ক্ষণে সাহরী খেলে সিয়াম পালন অধিকতর সহজ হয়, ফজরের সালাত আদায় করার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে কষ্ট করতে হয় না। সতর্কতা অবলম্বন করে ফজরের অনেক আগে সাহরী শেষ করা সুন্নত নয়। সাহরীর সময় শেষ হলো কি-না তা জানবেন নিজের চোখে পূর্বাকাশের শুভ্রতা দেখে, অথবা ক্যালেন্ডার ও ঘড়ির মাধ্যমে সূক্ষ্ণ হিসাব করে কিংবা নির্ভরযোগ্য মুয়াজ্জিনের ফজরের আযান শুনে।

 

(৯) সিয়াম পালনে সাহরীর সময়কে সুযোগ মনে করে কাজে লাগানো :

সাহরীর সময় অত্যন্ত মর্যাদা-পূর্ণ একটি সময়। এ সময় জাগ্রত হওয়ার কারণে আল্লাহ যা পছন্দ করেন এমন অনেক ভাল কাজ করা যায়। যেমন তিনি মুমিনদের প্রশংসায় বলেছেন :

‘তারা শেষ রাতে (সাহরীর সময়) ক্ষমা প্রার্থনা করে।'[১৪]

তিনি এ আয়াতে ঐ সকল জান্নাতবাসী মানুষদের প্রশংসা করেছেন যারা শেষ রাতে দোয়া-প্রার্থনা করে ও ক্ষমা চায় আল্লাহর কাছে। এর মাধ্যমে তারা যে জান্নাত লাভ করবে এর সুসংবাদও দেয়া হয়েছে। সাহরীর সময়টা এমন একটি সময় যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার নিকটতম আকাশে অবতরণ করেন। যে সকল মানুষ তখন তার প্রতি আগ্রহী হয়ে সালাত ও দোয়া-প্রার্থনা করে, তিনি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

‘আমাদের মহান প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। তখন মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলেন, যে আমার কাছে দোয়া করবে আমি তাতে সাড়া দেব, যে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব ও যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব।'[১৫]

অতএব সাহরীর সময় হল আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি দান-প্রতিদানের সময়। এ সময় সে ব্যক্তিই তার সামনে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন যিনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব ভালভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের নিয়তকে বিশুদ্ধ করেছেন। অনেক মানুষ এমন আছেন যারা এ সময় জাগ্রত হয়ে খাওয়া-দাওয়াসহ অনেক কাজ সমাধা করেন কিন্তু দোয়া- প্রার্থনা. ইস্তিগফার, তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার সুযোগ করে নিতে পারেন না।

শেষ রাতের সালাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

أيها الناس أفشوا السلام، وأطعموا الطعام، وصلوا الأرحام، وصلوا بالليل والناس نيام تدخلوا الجنة بسلام. الدارمي:১৪৬০

‘হে মানবসকল ! তোমরা সালামের প্রচলন কর। অন্যকে খাবার দাও। আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ আর রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা সালাত আদায় কর তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে যেতে পারবে।'[১৬]

 

(১০) সিয়াম শেষে ইফতারি করতে বিলম্ব না করা :

সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে রাতের আগমন ঘটে ও ইফতার করার সময় হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন :

‘অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পালন করবে।'[১৭]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

إذا أقبل الليل من هاهنا وأدبر النهارمن هاهنا وغربت الشمس فقد أفطر الصائم. البخاري :১৮৫৩

যখন এখান থেকে রাত্রির আগমন ঘটে ও ওখান থেকে দিন চলে যায় এবং সূর্য অস্ত যায় তখন সিয়াম পালনকারী ইফতার করবে।'[৬৮]

তাই ইফতারের আদব হল সূর্যাস্ত মাত্রই দেরি না করে ইফতার করা। সময় হওয়া মাত্র ইফতার করার ব্যাপারে অনেক হাদীসে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

‘মানুষ যতদিন পর্যন্ত সময় হওয়া মাত্র ইফতার করবে ততদিন কল্যাণের সাথে থাকবে।'[১৯]

তিনি আরো বলেছেন :

‘যতদিন মানুষ সময় হওয়া মাত্র ইফতার করবে ততদিন দ্বীন বিজয়ী থাকবে। কেননা ইহুদী ও খ্রিস্টানরা ইফতারিতে দেরি করে।'[২০]

হাদীসে আরো এসেছে,

قال أبو الدرداء رضي الله عنه : ثلاث من أخلاق النبوة : تعجيل الإفطار، وتأخير السحور، ووضع اليمين على الشمال في الصلاة. مصنف عبد الرزاق:৭৬১৭

আবু দারদা রা. বলেন : ‘তিনটি বিষয় নবী চরিত্রের অংশ : সময় হওয়া মাত্র ইফতার করে ফেলা, দেরি করে সাহরী খাওয়া ও সালাতে দাঁড়িয়ে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা।'[২১]

আমর ইবনে মায়মূন আওদী বলেন:

كان أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم أسرع الناس إفطارا وأبطأهم سحورا. عبد الرزاق:৭৫৯১

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাহাবীরা সকলের চেয়ে তাড়াতাড়ি (সময় হওয়া মাত্র) ইফতার করতেন ও সকলের চেয়ে দেরিতে সাহরী খেতেন।'[২২]

কোন ব্যক্তি দেখে-শুনে ধারণা করে নিল যে, সূর্য ডুবে গেছে ও সে ইফতার করে নিল অথচ সূর্য তখনও অস্ত যায়নি। এমতাবস্থায় তার সওমের কোন ক্ষতি হবে না। তবে ইফতার শুরু করার পর সে যদি বুঝতে পারে সূর্য এখনও অস্ত যায়নি তা হলে সাথে সাথে পানাহার থেকে বিরত হয়ে যাবে। তার বিষয়টা যে ভুলে পানাহার করেছে তার মতই।

কেন বিলম্ব না করে ইফতার ও দেরিতে সাহরী খাবেন?

প্রথমত: ইসলামী জীবনাদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ধর্মীয়, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ও লেবাস-পোশাকে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের অনুকরণ প্রত্যাখ্যান করা। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ. الجاثية :১৮

‘যাদের জ্ঞান নেই তুমি তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবে না।'[২৩]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

من تشبه بقوم فهو منهم .سنن أبي داود:৪০৩৩

‘যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।'[৭৪]

এ হাদীস দ্বারা বুঝে আসে, যে কাফেরদের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে সে কাফের হয়ে যাবে। যদি সে কাফের না-ও হয় তবে কাজটি যে হারাম বা নিষিদ্ধ এতে কোন সন্দেহ নেই।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহর রাব্বুল আলামীন তার বান্দাদের প্রতি পরম দয়ালু। তিনি মানুষদের কষ্ট দিতে চান না কখনো। মানুষের জন্য সব কিছু তিনি সহজ করতে চান। তাই সিয়াম পালনকারীর যাতে অযথা কষ্ট না হয় সে দিকে লক্ষ্য রেখে দেরি করে সাহরী ও সময় হওয়া মাত্র ইফতারের নির্দেশ এসেছে। সিয়াম পালন করা যেমন ইসলামের নির্দেশ, তেমনি সিয়ামের সময় শেষে পানাহার করাও ইসলামের নির্দেশ। এ নির্দেশ পালনে দেরি করা বা গড়িমসি করা কখনো ঠিক নয়।

তৃতীয়ত : রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাহাবীগণ তাঁর অনুসরণের ব্যাপারে কত যত্নবান ছিলেন সেটা লক্ষণীয়। প্রতি পদে পদে রাসূলের অনুসরণ করার জন্য আমাদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে।

আল্লাহ বলেন :

‘বল ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।'[২৫]

তিনি আরো বলেন :

‘রাসূল তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসেছেন তা ধারণ কর। আর যা থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।'[২৬]

কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের মাঝে কিছু শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন : অনেকে নিশ্চিত হয়েছেন যে সূর্যাস্ত হয়েছে, তারপরও ইফতার শুরু করার জন্য আজানের অপেক্ষা করেন। আবার অনেকে মনে করেন সূর্য ডুবে গেছে ঠিকই কিন্তু মাগরিবের আযান না শুনে ইফতার করব কীভাবে? আবার অনেকে আযান শোনার পর ইচ্ছে করেই সতর্কতা অবলম্বন করতে যেয়ে কিছুক্ষণ বিলম্ব করেন। অনেক সময় আযান হয়ে যাওয়ার পর দোয়া-প্রার্থনায় রত থাকতে দেখা যায়। এগুলো পরিহার করা উচিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সুন্নত অনুযায়ী সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার শুরু করে দেয়া কর্তব্য।

 

(১১) সিয়াম শেষে যে সকল খাদ্য দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব:

عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال :كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يفطر على رطبات قبل أن يصلي، فإن لم يكن رطبات فتمرات، فإن لم يكن تمرات، حسا حسوات من ماء. أحمد:১৩০১২

আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতের পূর্বে তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর না পাওয়া যেত তবে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি শুকনো খেজুর না পাওয়া যেত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন।'[২৭]

এ হাদীস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ইফতারের আদব হল: মাগরিবের সালাতের পূর্বে ইফতার করা। তাজা খেজুর বা শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করা। খেজুর দিয়ে ইফতার করার উপকারিতা হল, খেজুর সহজপাচ্য। দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে থাকার কারণে খাওয়ার পর যে সমস্যা হওয়ার কথা খেজুর খেলে তা হয় না। উপরন্তু খেজুর হালকা খাবারের একটি। পানি, খেজুর এগুলো দ্বারা ইফতার করলে অলসতা সৃষ্টি হয় না।

দ্বিতীয়ত পেট পুরে পানাহার ইসলাম সমর্থন করে না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

ما وعي ابن آدم وعاء شرا من بطنه، بحسب ابن آدم أكلات يقين صلبه، فإن كان لا محالة فاعلا فثلث لطعامه، وثلث لشرابه، وثلث لنفسه. الحاكم:৭১৩৯

‘মানুষ সে সকল পাত্র পূর্ণ করে তার মাঝে মানুষের পেট অপেক্ষা আর কোন খারাপ পাত্র নেই। মানুষের কোমর সোজা রাখার জন্য কয়েকটি লোকমা-ই যথেষ্ট। এর থেকেও বেশি যদি প্রয়োজন হয়, তবে পেটের এক তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচলের জন্য রেখে দেয়া উচিত।'[২৮]


(১২)
সিয়াম পালন অবস্থায় ইফতারের সময় দোয়া করা :

সিয়াম পালনকারীর দোয়া কবুল হয়। বিশেষ করে ইফতারের সময়। কারণ ইফতারের সময়টা হল বিনয় ও আল্লাহর জন্য ধৈর্য ধারণের চরম মুহূর্ত। এ সময় জাহান্নাম থেকে মুক্তি দানের মুহূর্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

إن لله تعالى عند كل فطر عتقاء من النار، وذلك كل ليلة، لكل عبد منهم دعوة مستجابة. البيهقي:৩৬০৫

‘ইফতারের সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর এটা রমজানের প্রতি রাতে। সিয়াম পালনকারী প্রত্যেক বান্দার দোয়া কবুল হয়।'[২৯]

ইফতার করার পর এ দোয়াটি পাঠ করা সুন্নত্ত

ذَهَبَ الظَمَأُ، وَابْتَلَّتِ العُرُوْقُ، وَثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ. أبو داود :২৩৫৭

অর্থ : ‘পিপাসা নিবারণ হল, শিরা-উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কার নির্ধারিত হল।'[৩০]

ইফতারের সময়টা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার একটা সুযোগ। এ সময়টা যেন বৃথা না যায় এ দিকে খেয়াল রেখে সময়টাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। ইফতারের সময় অন্তর দিয়ে দোয়া-প্রার্থনা করা এবং যা কিছু দোয়া কবুলের অন্তরায় তা থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। যেমন হারাম বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত খাদ্য গ্রহণ। দোয়া কবুলের কত চমৎকার সময় যে, আল্লাহ নিজে যখন দোয়া কবুলের ওয়াদা করেছেন !

‘আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে, আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেই। সুতরাং তারা আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক যাতে তারা ঠিক পথে চলতে পারে।'[৩১]

ইফতারের সময় ও আজানের পরের সময়টাও দোয়া কবুলের সময়। হাদীসে এসেছে প্রতি আযান ও একামতের মধ্যবর্তী সময়ে দোয়া কবুল হয়।


(১৩)
সিয়াম পালন এবং বেশি করে ভাল ও কল্যাণ মূলক কাজ করা এবং কুরআন পাঠ করা।

রমজান হল কুরআন নাযিলের মাস। কুরআন নাযিলের কারণে রমজান মাসের এত মর্যাদা। এ মাসে অবশ্যই অন্য সকল সময়ের চেয়ে বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। হাদীসে এসেছে,

عن عبد الله بن عمرو أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة، يقول الصيام أي رب: منعته الطعام والشهوات بالنهار، فشفعني فيه. ويقول القرآن : منعته النوم بالليل، فشفعني فيه. قال فيشفعان. أحمد:৬৬২৬

আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘সিয়াম ও কুরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কুরআন বলবে হে প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তিনি বলেন, অতপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে।'[৩২]

 

(১৪) সিয়াম পালন এবং ইবাদত-বন্দেগীতে তাওফীক দানের ব্যাপারে আল্লাহর অনুগ্রহ অনুধাবন করা :

একটু চিন্তা করে দেখা যেতে পারে যে, কত মানুষ রয়েছে যাদেরকে আল্লাহর তার ইবাদত-বন্দেগী করতে সামর্থ্য দেননি কিন্তু আমাকে দিয়েছেন। এটা আমার প্রতি তাঁর এক মহা-অনুগ্রহ। এরপর তিনি যদি আমার এ ভাল কাজগুলো কবুল করে আমাকে প্রতিদান দেন তাহলে এটা হবে তাঁর পক্ষ থেকে আরেকটি অনুগ্রহ। কত মানুষ ভাল কাজ করে কিন্তু সকলের ভাল কাজ-তো কবুল করা হয় না।

إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ المائدة : ২৭

‘আল্লাহ মুত্তাকীদের কাজই কবুল করেন।'[৩৩]

এ ধরনের অনুভূতি থাকলে নেক-আমল করে আত্ম-তৃপ্তি ও অহংকার নামক ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়। কেননা অহংকার ও আত্ম-তৃপ্তি ভাল কাজের প্রতিদান নষ্ট করে দেয়। তখন ভাল কাজগুলো মরীচিকার মত হয়ে যায়।

 

(১৫) সিয়াম অবস্থায় দরিদ্র ও সহায় -সম্বলহীনদের প্রতি মমতা ও তাদের সেবা করা :

সিয়াম পালনের মাধ্যমে অসহায় সম্বলহীন, অভুক্ত মানুষের প্রতি দয়া ও মমতা সৃষ্টি হয়। তাদের অসহায়ত্ব অনুভব করা যায়। তাই এ দান-প্রতিদানের পবিত্র মাসে তাদের জন্য বেশি করে কল্যাণকর কাজ করা উচিত। ইফতার করানো, সদকাতুল ফিতর, যাকাত আদায় করার সাথে সাথে ব্যাপকভাবে দান-সদকা করা যেতে পারে। হাদীসে এসেছে,

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود الناس بالخير، وكان أجود ما يكون في شهر رمضان. مسلم:২৩০৮

‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তার দানশীলতা আরো বেড়ে যেত।'[৩৪]

 

(১৬)সিয়াম পালন এবং  সুন্দর চরিত্র, ধৈর্য ও উত্তম আচরণ দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করুন :

রমজান হল ধৈর্যের মাস আর সিয়াম হল একটি বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয় থাকাকালীন অবশ্যই সদাচরণ, ধৈর্য, সুন্দর চরিত্রের অনুশীলন করতে হবে। রোজাদারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সে যেন মূর্খতাপূর্ণ আচরণকারীর জবাব না দেয়, তার সঙ্গে যে ভ্রান্ত আচরণ করে তাকে বলে দেয়,’ আমি রোজাদার‘। সর্বোপরি তাকে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে।

 

(১৭) সিয়াম পালন অবস্থায় অপচয় ও অযথা খরচ থেকে বিরত থাকুন :

অপচয় তা যে কোন বিষয়েই হোক ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ। পবিত্র মাসে যখন আমাদের বেশি করে সৎকাজ করা উচিত তখন আমরা খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোন ধরনের অপচয় করে যেন পাপ অর্জন না করি। রমজান মাসে দেখা যায় অনেকে খেতে পারব মনে করে অনেক কিছু আয়োজন করে। অবশেষে খেতে না পেরে তা নষ্ট করে ফেলে। এটা সত্যিই অন্যায়।

 

(১৮) সিয়াম পালন এবং রুটিন করে সময়টাকে কাজে লাগান :

রমজানের সময়টা অন্য সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সংক্ষিপ্ত মনে হয়। তাই আপনি রুটিন করে সময়টাকে কি কি কাজে ব্যয় করবেন তা যদি ঠিক করে না নেন তাহলে দেখবেন অনেক কাজই অসমাপ্ত রয়ে গেছে। অনর্থক কথা-বার্তা, আড্ডা বাজি, গল্পগুজব, নিষ্ফল বিতর্ক ইত্যাদি পরিহার করুন। কোন কথা বা কাজ করার আগে ভেবে দেখুন কথা বা কাজটা আপনার জন্য কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনবে। আমার পাশে বসে অন্য লোক একটি বিষয় আলোচনা করছে তাই আমাকে অংশ নিতেই হয়্ততাই একটু বললামএমন যেন না হয়। অযথা কথা ও কাজ পরিহার করা সিয়াম পালনের একটি শিক্ষা ও দাবি।

 

(১৯) সিয়াম পালনে দুনিয়াবি ব্যস্ততা কমিয়ে দিন :

রমজান মাসে নিজের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের জন্য দুনিয়াদারির ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়ে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করুন। অনেকেই রমজান মাসকে অর্থ উপার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুনাফা লাভের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। এ দিকেই বেশি সময় ব্যয় করেন। দুনিয়াদারি যতটুকু না করলেই নয় ততটুকুতো অবশ্যই করবেন। আর বাকি সময়টা আখেরাতের মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যয় করুন।

 

(২০) সিয়াম অবস্থায় খাওয়া ও নিদ্রায় ভারসাম্য বজায় রাখুন :

আমাদের মাঝে অনেকে রমজান মাসে যেমন খাওয়া দাওয়া বেশি করে তেমনি আবার বেশি সময় ঘুমিয়ে কাটায়। তারাবীহ ও সাহরীর কারণে যদি রাতে দু ঘণ্টা নিদ্রা কম হয় তবে দিনে তার কাফফারা আদায় করে চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে। খাবার ব্যাপারে অনেকে একই নীতি অনুসরণ করে। যদি এরকমই আমাদের অবস্থা হয় তবে আমরা রমজানের জন্য কি কুরবানী করলাম? বিষয়টা গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত।

আল্লাহ আমাদের নেক আমল সমূহ কবুল করুক, আমিন!

রমজান বিষয়ক সুন্দর দুটি বই
ধূলিমলিন-উপহার-রামাদান; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :من قام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه. مسلم'যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রাতে সালাত আদায় করবে তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।'[৩৩] ## নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة .أحمد'সিয়াম ও কুরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে...।'[৩৫]

ফুট নোটঃ 

[১] সূরা বাকারা : ২০৮

[২] দারামী : ২৭২০

[৩] মুসলিম : ১১৫১

[৪] হাকেম : ১৫২০

[৫] বুখারী : ৬০৫৭

[৬] সূরা আল-বাইয়েনা: ৫

[৭] বুখারী : ২০১৪, মুসলিম : ১৮১৭

[৮] মুসলিম : ৪৫৯০

[৯] সূরা মায়িদাহ: ২৭

[১০] বুখারী : ১৯২৩, মুসলিম : ২৬০৩

[১১] মুসলিম : ২৬০৪

[১২] আবু দাউদ : ২৩৪৭

[১৩] আহমদ : ১১৩৮৪

[১৪] সূরা যারিয়াত: ১৮

[১৫] বুখারী : ১১৪৫, মুসলিম : ১৮০৮

[১৬] দারামী : ১৪৬০

[১৭] সূরা বাকারা : ১৮৭

[১৮] বুখারী : ১৮৫৩

[১৯] বুখারী : ১৮৫২, মুসলিম : ১০৯৮

[২০] আবু দাউদ : ২৩৫৫

[২১] মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ৭৬১৮

[২২] মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক : ৭৫৯১

[২৩] সূরা জাসিয়া, আয়াত ১৮

[২৪] আবু দাঊদ : ১৪৩৩

[২৫] সূরা আলে ইমরান : ৩১

[২৬] সূরা হাশর, আয়াত: ৭

[২৭] আহমদ : ১৩০১২

[২৮] হাকেম : ৭১৩৯

[২৯] বাইহাকী : ৩৬০৫

[৩০] আবু দাউদ : ২৩৫৭

[৩১] সূরা আল-বাকারা : ১৮৬

[৩২] আহমদ : ৬৬২৬

[৩৩] সূরা মায়িদা : ২৭

[৩৪] মুসলিম : ৩২০৮

_________________________________________________________________________________

সংকলন: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

সম্পাদনা : মুহাম্মদ শামসুল হক সদ্দিকি

সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

———————-——————————

লেখাঃ আল্লাহ্‌র কোন এক বান্দা 

ইসলাম সম্পর্কে আরো পড়তে এখেন ক্লিক করুন  ☑

FACEBOOK   |  YOU-TUBE  | PINTEREST 
NOBIJI.COM/YOUTUBE


0 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published.