– আশুরার ইতিহাস নিয়ে যত কথা –

আরবি ‘শাহরুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মাসআর ‘মুহাররম’ শব্দের অর্থ সম্মানিত। সুতরাং ‘শাহরুল মুহাররম’ এর যৌগিক  অর্থ হলো ‘সম্মানিত মাস।’আরবি ‘মুহাররম’ থেকেই ‘মহররম’ শব্দটি বাংলা সাহিত্যে ও বাংলাভাষী মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে। সে যাইহোক, মহররম হলো হিজরি সনের প্রথম মাস। যা আল্লাহ তায়ালার নিকট সম্মানিত চার মাসের এক মাস। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন,

“নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২, যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।”(সুরা তাওবা : ৩৬)

এ মাসের দশ তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা।’ কারণ, আরবি ‘আশারা’ থেকে এর উৎকলণ। যার অর্থ হচ্ছে দশ। তাই এ মাসের দশ তারিখকে পবিত্র আশুরা বলে অবহিত করা হয়। আদিকাল থেকেই যুগে যুগে আশুরার এই দিবসে বহু স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা আমরা পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরীফ থেকে জানতে পাই। হাদিসে এসেছে আল্লাহ রাববুল আলামিন যেদিন আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জান্নাত-জাহান্নাম, লাউহু মাহফুজ ও যাবতীয়  সৃষ্টিজীবের আত্মা সৃজন করেছেন, সে দিনটি ছিল ১০ই মুহাররম তথা পবিত্র আশুরার দিবস। আবার এ দিনেরই কোনো এক জুমাবারে হযরত ইস্রাফিল আঃ. এর ফুঁৎকারে নেমে আসবে মহা প্রলয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায় যাকে বলা হয় কেয়ামত।

এছাড়াও ইসলামের আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে এ আশুরাতেই। এই যেমন- আদি পিতা হযরত আদম আ. কে সৃষ্টি করা হয় এ দিনে, এ দিনেই হযরত আদম আ. কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় অাবার ভুলের কারণে তাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণের পর এ দিনই তাঁর তাওবা কবুল করা হয়। এমনিভাবে এ দিনে জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আ. জন্মগ্রহণ করেন, নবী আইয়ুব (আ.) দীর্ঘ ১৮ বছর কুষ্ঠরোগ ভোগ করার পর আরোগ্য লাভ করেছিলেন আশুরার দিন। আবার এদিনেই নমরুদের বিশাল অগ্নিকুন্ড হতে মুক্তিলাভ করেন। এই আশুরাতেই তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে হযরত মুসা আ. কথোপকথন ও আসমানী কিতাব ‘তাওরাত’ লাভ করেন, আবার এই ১০ই মহররমেই জালেম ফেরাউনের দলবলসহ নীল দরিয়ায় সলিল সমাধি হয়। তদ্রূপ, হযরত নুহ আ. ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মহাপ্লাবন হতে মুক্তি লাভ, মাছের পেট হতে হযরত ইউনুস আ. এর পরিত্রাণ, আসমান হতে বৃষ্টি বর্ষণের সূচনা এ সব কিছুই সংঘটিত হয়েছে ১০ই মহররম অর্থাৎ আশুরার দিনে। মোট কথা এই ১০ই মহররম যেন ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী। তাই শরিয়তের দৃষ্টিতে এ দিনটির রয়েছে অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য। মহাররম মাসের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরীফে বহু বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে। অার এসব ফজিলতের আলোকে মুসলিম উম্মাহর জন্য এ মাসের সুনির্দিষ্ট আমল হলো ‘আশুরার সিয়াম।’

হযরত আলী রা. কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন, রমযানের পর আর কোনো মাস আছে কী, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূল সা. এর নিকটও জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূল সা. বললেন,

”রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে,যে দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তাওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তাওবা কবুল করবেন।” (জামে তিরমিযী, ১ ১৫৭)

মহররম মাসের রোজা সম্পর্কে অনেক বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমনটি ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তদুপরি নিম্নে কয়েকটি হাদিস উপস্থাপন করা হল। হাদিস থেকে জানা যায়, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজাই উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর ফরজ ছিল। পরবর্তী সময়ে ওই বিধান রহিত হয়ে তা নফলে পরিণত হয়। হাদিসটি হলো,

“রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।” (সুনানে কুবরা, ৪২১০)

 

হযরত জাবের রা. এর সূত্রে বর্ণিত আছে, ”রাসূল সা. আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না। (মুসলিম,১১২৮)

হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী সা. যখন হিজরত করে মদিনায় পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মুসা আ. ও বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরআউন ও তার বাহিনীকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হযরত মুসা আ. রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি।

তাদের উত্তর শুনে নবী করিম সা.বললেন, হযরত মুসা আ. এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করলেন। (বুখারি-৩৩৯৭, মুসলিম-১১৩৯)

মুসলিম শরিফের এক হাদিসে হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সা. যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সা. ইহুদি-নাসারারাওতো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসূল সা.বললেন,

”তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব। (মুসলিম-১১৩৪)

ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর সাথীবৃন্দ, ইমাম আহমাদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ বলেছেন, আশুরার রোজার ক্ষেত্রে দশম ও নবম উভয় দিনের রোজাই মুস্তাহাব। কেন না ররাসূল সা. দশ তারিখ রোজা রেখেছেন এবং নয় তারিখ রোজা রাখার নিয়ত করেছেন। হযরত আবু কাতাদা রা. এর সূত্রে বর্ণিত, রাসুল সা. কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

“এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়।” (মুসলিম-১১৬২)

 

৬৮০ সালে এই দিনে বর্তমান ইরাকের কারবালা নামক স্থানে ইসলামের নবী মোহাম্মদের দৌহিত্র হোসাইন ইবনে আলীকে, যিনি ইমাম হোসাইন নামে পরিচিত, প্রতিপক্ষ নির্মমভাবে হত্যা করে। কারবালার সেই ট্রাজেডিময় ঘটনাটিও যুক্ত হয় আশুরা পালন করার ক্ষেত্রে। বিশেষ করে শিয়া মতাবলম্বীদের পাশাপাশি সুন্নিদের কাছেও এ ঘটনা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

হিজরি ৬১ সনের এই দিনে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা কারবালার ময়দানে ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে শহীদ হন। শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে হজরত ইমাম হোসাইনের (রা.) আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কারবালার শোকাবহ ঘটনা অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে প্রেরণা জোগায়।

উপরোক্ত বিষয় গুলো হলো করণীয়, এর বাইরে হযরত হুসাইন রা. এর কথা স্মরণ করে, কারবালার কথা স্মরণ করে যা কিছু করা হচ্ছে, যেমন: মাতম করা হচ্ছে, বুক চাপড়ানো হচ্ছে, হায় হুসাইন হায় হুসাইন, ইয়া আলী! বলে আবেগ জাহির করা হচ্ছে, শোক মিছিল করা হচ্ছে, তাযিয়া বের করা হচ্ছে, এগুলো মানুষের সৃষ্টি করা রছম ও কুসংস্কার। কুরআন ও হাদীসে এর কোন ভিত্তি নেই। শিয়া সম্প্রদায় এ সমস্ত শুরু করেছে, আর তাদের দেখাদেখি সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এগুলো চালু হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এগুলো থেকে হেফাযত করুন এবং আশুরার ফযীলত অর্জন করার তাওফীক দান করুন।

ইসলাম সম্পর্কে আরো পড়তে এখেন ক্লিক করুন  ☑

FACEBOOK   |  YOU-TUBE  | PINTEREST 
আত্তাহিয়াতু